আমার একমাত্র ছোট ভাইয়ের বিমান বাহিনীতে চাকুরি হয়। ১৯৯৭ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারি চিটাগাং বিমান বাহিনীর ঘাঁটিতে ট্রেনিং এর উদ্দেশ্যে সে ঢাকা থেকে ট্রেনে চিটাগাং রওনা হয়। আব্বা -আম্মা তাকে বিদায় দিতে তার সাথে ঢাকা আসে। ট্রেন চোখের আড়াল হলে দুজনে চোখ ভর্তি পানি নিয়ে আমার বড় বোন ঢাকায় থাকে তার বাসায় গেল। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে বিকালের ট্রেনে নরসিংদী আমাদের নিজেদের বাড়িতে চলে যায়।
বাসায় আমাদের তিন বোন আব্বা-আম্মা সবারই মন খারাপ ভাইয়ের জন্য। আব্বার বাসায় ভালো না লাগাতে বাসা থেকে বের হয়ে আসে পাশে সবার বাসায় গিয়ে গল্প করে রাত প্রায় সাড়ে আটটার দিকে বাসায় গিয়ে সবাইকে নিয়ে রাতের খাবার খায়।
আম্মা ভাইয়ের ছোট খাটে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যায়। দুই বোনও ঘুমিয়ে যায়। আব্বা আর ছোট বোন টেলিভিশন দেখতে ছিল। এর মধ্যে আব্বাও ঘুমিয়ে যায়। ছোট বোন একা একাই টেলিভিশন দেখছিল।
হঠাৎ রাত সাড়ে দশটার দিকে আব্বার ঘুম ভেঙে যায়। তখনও ছোট বোন টেলিভিশন দেখছিল। আব্বা ওকে বলল আব্বার শরীর ভালো লাগছে না আম্মাকে যেন ডেকে দেয় আমাদের বাসার পাশেই ফার্মেসি আছে সেখানে প্রেসার মাপাতে যাবে।
ছোট বোন আম্মাকে ডেকে তুলে আলনা থেকে আব্বাকে শার্ট দেয় পরার জন্য। আব্বা নিজ হাতে কলাপসিপল গেটে তালা দিয়ে ছোট বোনের হাতে চাবিটা দেয় আর বলে না ঘুমাতে, আব্বা -আম্মা আসলে যেন গেট খুলে দেয়।
আব্বা -আম্মা গিয়ে দেখে ফার্মেসি বন্ধ। তখন আব্বা রাস্তায় বসে পরে। আম্মা কি যে করবে বুঝতে পারছিল না। সেই মুহুর্তে সেখান দিয়ে একটা বিশ বাইশ বছরের ছেলে রিকশা নিয়ে যাচ্ছিল। আম্মা রিকশাওয়ালাকে বলল সদর হাসপাতালে যাবে কি না।রিকশাওয়ালা আব্বার অবস্থা দেখে রাজী হয়।
কারো সাহায্য ছাড়া আব্বা একাই রিকশায় উঠে। আব্বা আম্মা রিকশায় করে সদর হাসপাতালে রওনা হয়। হাসপাতালে যাওয়ার পর রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিতে গিয়ে আম্মার মনে হয় টাকার কথা। আব্বার পকেটে আম্মা পাঁচ টাকা পায়। এ অবস্থা দেখে রিকশাওয়ালা আম্মাকে ভাড়ার কথা চিন্তা করতে নিষেধ করে। বলে যে ডাক্তার দেখায় বাসায় নিয়ে আসার পর টাকা দিলেই চলবে। ইমার্জেন্সিতে যাওয়ার পর ডাক্তার আব্বাকে দেখে আম্মাকে ডাক্তারের রুমে নিয়ে বলে আব্বার হার্টএটাক করেছে। এখনই একটা ইনজেকশন দিতে হবে। আম্মার কাছে যেহেতু টাকা নাই রিকশাওয়ালা নিজের টাকা দিয়ে ইনজেকশন কিনে আনে। আব্বা যেহেতু বিমান বাহিনীতে চাকুরি করতেন ডাক্তার আম্মাকে বলল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আব্বাকে যেন সি এম এইচে নিয়ে যান।
হাসপাতালে তখন এমবুলেন্স ছিল না। আব্বার খুবই ঘনিষ্ট এক বন্ধু ছিল যার একটি প্রাইভেট কার ছিল।অনেক বেশী বড়লোক হওয়াতে আমাদের সাথে তাদের যোগাযোগ কম ছিল। আম্মা এত রাতে কোথায় যাবে কি করবে কোন উপায় না পেয়ে আম্মা রিকশাওয়ালাকে নিয়ে সে বাসায় গেলেন।দরজা নক করলে আব্বার বন্ধুর মেয়ে এসে দরজা খুলে। আম্মা সব কথা তাকে বললে সে বলল, “আব্বু ঘুমিয়ে আছে এখন ডাকা যাবে না। আপনি সকাল দশটার দিকে অফিসে দেখা করেন।”
দরজা থেকেই আম্মাকে বিদায় করে দেয়। রিকশাওয়ালা সব শুনে বলল, “ঠিক আছে খালাম্মা চলেন আমরা এখন হাসপাতালে চলে যাই। আপনি খালুকে দেখে বাসায় গিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে আসেন আমি সকালের প্রথম যে বাসটা যাবে সেটাতেই আপনাদের তুলে দিব।”
আম্মার আর করার কিছু ছিল না, হাসপাতালেই ফিরে গেল। আম্মা ইমার্জেন্সি রুমে গিয়ে দেখে আব্বা ঘুমিয়ে আছে। এটেন্ড্রেন্স আম্মাকে দেখেই ডাক্তারকে নিয়ে আসেন। ডাক্তার আম্মাকে উনার রুমে নিয়ে যান। আম্মার কাছে সব কথা শুনেন। ছেলে মেয়ে কোথায় থাকেন আরো অনেক কিছু। আম্মা সব কথার উত্তর দেন। অনেক ক্ষণ পরে ডাক্তার অনেক কিছু বুঝিয়ে আম্মাকে আব্বার মৃত্যু সংবাদ দেন। আম্মা বের হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই মার্চের এক তারিখ রাত সোয়া বারোটায় আব্বা মারা যান।
আম্মা যেন পাথর হয়ে যান। রিকশাওয়ালা নিজে আম্মাকে বললেন, “খালাম্মা আমি আপনাকে বাসায় নিয়ে যাব। লোকজন নিয়ে এসে খালুকে নিয়ে যাব।”
আম্মা বাসায় না গিয়ে পাশের বাসার খালাম্মার দরজায় নক করলেন। এতরাতে কাকা আম্মাকে দেখে অবাক। আম্মা কিছুই বলতে পারছিল না। রিকশাওয়ালাই কাকাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে সব বলল। পরে কাকাই আশেপাশের সবাইকে খবর জানালো এবং আব্বাকে নিয়ে আসলেন।
আমার ছোট বোন তখনও সজাগ,বসে টিভি দেখছে। সে যখন আব্বার লাশ নামানো দেখছে সেই রাতের কথা এখনও সে মনে করতে পারে না।
তখনও আমার তিন বোনের বিয়ে হয়নি। পেনশনের পুরো টাকা দিয়ে আব্বা বাড়ি তৈরি করেছেন। টাকার খুব সমস্যায় ছিলেন।তিন বোনেই বিয়ের উপযুক্ত। আব্বা ভিতরে ভিতরে সারাক্ষণ মনে হয় এগুলো চিন্তা করতেন। আমরা কেউ বুঝতে পারিনি।
আল্লাহর রহমতে আজ আমরা কয়টা গাড়ি লাগবে তা দিয়েই আব্বাকে ঢাকা নিয়ে আসতে পারতাম। কিন্তু সেদিন আব্বার বন্ধুর মেয়ে ভালো করে আম্মার কথাই শুনলো না।
এই পৃথিবীতে কখন যে কার কাছে হাত পাততে হয় তা একমাত্র আল্লাহ ভালো যানেন।
আমাদের মাথার উপর থেকে বট বৃক্ষের ছায়াটা হারিয়ে গেল। যে সুশীতল ছায়ার নীচে এতদিন আমরা পরম নিশ্চিন্তে ছিলাম।
কখন যে কে কার উপকারে আসবে আমরা কেউই বলতে পারি না। আমরা হয়তো মনে করি ওরা আমাদের কি উপকার করবে?
কিন্তু রিকশাওয়ালা ভাইটা সেদিন আমাদের আব্বা আম্মাকে যে উপকার করছে তা আমরা কখনোই ভুলবো না। আল্লাহ যেন ভাইটাকে সারাজীবন ভালো রাখেন।
লেখক,
আফরোজা মুন্নি
ঢাকা, বাংলাদেশ